রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০১ অপরাহ্ন
শায়খ ড. আলী আল-হুযাইফি:
আল্লাহতায়ালা মানুষের দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণ-সংশ্লিষ্ট প্রয়োজন সম্পর্কে জানেন। তিনি এটাও জানেন, মানুষের জ্ঞান-গরিমা যতই উচ্চতর হোক, অভিজ্ঞতা যত উন্নত হোক তারা কখনো দুনিয়া ও পরকালের সাধারণ রীতির রহস্য ভেদ করতে পারবে না। তাই তিনি মানুষের কাছে ইহকালীন ও পরকালীন এই রীতির উপকরণগুলো বর্ণনা করে তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের দুর্ভাগ্যের কারণসমূহ থেকে সতর্ক করেছেন। এটা মহান রবের পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত ও দয়া।
নবী করিম (সা.) জ্ঞান, হেকমত, স্বভাবগত, সৃষ্টিগত ও চরিত্রগত দিক থেকে পরিপূর্ণ এবং মানবজাতির সর্দার। তার পরও তাকে আল্লাহ অহির মাধ্যমে যতটুকু জানিয়েছেন, এর বাইরে আর কিছুই জানতেন না। তিনি সৌভাগ্য অর্জনের মাধ্যম সম্পর্কেও জানতেন না। এমতাবস্থায় উম্মতের অন্যদের ইহকাল ও পরকালের সৌভাগ্যের কারণ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকাই স্বাভাবিক। তবে আল্লাহতায়ালা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর যা নাজিল করেছেন, তার মাধ্যমে তারা জানতে পারেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হেকমত নাজিল করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আপনার প্রতি আল্লাহর মহা-অনুগ্রহ রয়েছে।’ সুরা নিসা : ১১৩
মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও বয়স যতই উন্নত, শক্তিশালী ও দীর্ঘ হোক না কেন তারা নবীদের ওপর অবতীর্ণ অহি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই দুনিয়া ও পরকালের সৌভাগ্যের পথ খুঁজে পাবে না। আর আল্লাহ যেহেতু জানেন, মানুষ হেদায়েতের বৃত্তান্ত ও শরিয়তের বিভিন্ন বিধানের রহস্য জানতে অক্ষম, তাই মহান আল্লাহ মানুষের কাছে এ বাস্তবতা বর্ণনা করেছেন। কোরআন মাজিদের বহু আয়াতে তিনি এমন অর্থবোধক কথা বলেছেন। অনুরূপভাবে তিনি নিজ অনুগ্রহ ও দয়ায় তার বান্দাদের জন্য পূর্ণ হেদায়েতের পথ বর্ণনা করারও দায়িত্ব নিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমার কাজ শুধু পথনির্দেশ করা।’ সুরা আল লাইল : ১২
মানুষকে তাদের কর্ম অনুসারে দুনিয়া ও আখিরাতে প্রতিদান দেওয়া হবে। আমাদের রব চূড়ান্ত করেছেন, ফয়সালা দিয়েছেন ও ওয়াদা করেছেন, পার্থিব জীবনে ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের সফলতা ও চিরসুখের জীবন নিহিত রয়েছে মাত্র দুটি কালেমায় আল্লাহর কালামের প্রতি ইমান আনায় এবং আল্লাহর কালাম অনুপাতে আমল করায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বনী আদম! যদি তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে রাসুলরা আসেন, যারা আমার আয়াতগুলো তোমাদের কাছে বিবৃত করবেন, তখন যারা তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং নিজেদের সংশোধন করবে, তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ সুরা আরাফ : ৩৫
মানব ইতিহাস ও নিজ উম্মতের সঙ্গে রাসুলদের ইতিহাস চাক্ষুষ প্রমাণ করে, সৌভাগ্যবান, সফল, বিজয়ী, জমিনের সংস্কারক এবং দুনিয়ার লাঞ্ছনা ও আখিরাতের আজাব থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ও শ্রেষ্ঠ মানুষ হলেন রাসুল এবং তাদের অনুসারীরা। যারা আল্লাহর কালামের প্রতি ইমান এনেছিলেন ও তদনুযায়ী আমল করেছিলেন।
আপনি কি তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে চান না? প্রথম মানুষ আমাদের পিতা হজরত আদম (আ.) ভুল করার পর আল্লাহর কালামের প্রতি ইমান আনা ও তদনুযায়ী আমল করার ফলেই তিনি হেদায়েত পেয়েছিলেন। হজরত আদম (আ.)-এর পর অন্য নবী-রাসুলদেরও মহান আল্লাহ স্বীয় কালাম ও অহি দ্বারা অনুগ্রহ এবং তাদের ও তাদের অনুসারীদের প্রশংসা করেছেন; যখন তারা আল্লাহর আয়াতকে গ্রহণ করে সে অনুযায়ী আমল করেছিল ও মানুষকে ওই পথে দাওয়াত দিয়েছিল।
আল্লাহ ও তার কালামের প্রতি ইমান আনা এবং তদনুযায়ী আমল করাই হচ্ছে দুনিয়ার সফলতা, এতেই রয়েছে পরকালীন কল্যাণ। আল্লাহর কিতাবগুলোর প্রতি ইমান আনার পাশাপাশি ইমানের দোকানগুলোতে বিশ্বাস স্থাপন ছাড়া আল্লাহ কোনো বান্দার সৎকাজ কবুল করবেন না ও কাউকে জাহান্নামের আজাব থেকে নাজাত দেবেন না।
এ জগৎ ও সমাজকে শুধু আল্লাহর কালাম, তার শরিয়ত ও তার কিতাবই সংস্কার করতে পারে, যা পর্যাপ্ত জীবিকা ও রিজিক লাভের মাধ্যম। আল্লাহর কালামের তিলাওয়াত ও তদনুযায়ী আমল পবিত্র জীবন ও জান্নাতের নেয়ামত লাভের মাধ্যম। বস্তুত জান্নাত ও তাতে বিদ্যমান চিরস্থায়ী নেয়ামতগুলো আল্লাহ তাদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, যারা তার কালামে বিশ্বাস করে ও তদনুযায়ী আমল করে। যারা আল্লাহর কালামে বিশ্বাস করে ও তদনুযায়ী আমল করে তাদের তিনি প্রশংসা করেছেন। এ জাতীয় ইমানের জন্য আল্লাহ যাদের প্রশংসা করেছেন তাদের অন্যতম হলেন সৃষ্টির মহাসম্মানিত ব্যক্তি নবী মুহাম্মদ (সা.)।
আল্লাহর কাছে সম্মানিত এই নবীকে পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনীন শরিয়ত দেওয়া হয়েছে। এই শরিয়তের দৃষ্টিতে আল্লাহর কাছে সম্মান শুধু তাকওয়ার ভিত্তিতে। মানবজাতিকে মহান আল্লাহ এই কোরআনের মাধ্যমে অনুগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে তিনি সত্য বর্ণনা করেছেন, যা নিয়ে আহলে কিতাবরা মতবিরোধ করেছিল।
এই শরিয়তের পূর্ণাঙ্গতা ও দয়ার নিদর্শন হলো তা ইনসাফ, বিশ্বস্ততা ও হকের সঙ্গে সব মানুষের প্রয়োজন বাস্তবায়ন করে ও তাতে সাড়া দেয় এবং জীবনের সব দিককে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করে। কিছু মুসলিমদের মধ্যে যেসব ত্রুটি দেখা যায়, তা শরিয়তের কারণে নয়, বরং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় শরিয়ত বাস্তবায়নে অজ্ঞতার কারণে হয়ে থাকে। উম্মতের মধ্যে আসা সমস্যা ও মাসয়ালার সমাধানের ক্ষেত্রে শরিয়ত অপারগ নয় এবং কখনো অপারগ হবে না। কেননা শরিয়ত ও হুকুম-আহকামের উৎস সুপ্রতিষ্ঠিত, যা পরিবর্তন হবে না এবং তাতে মানবীয় প্রবৃত্তি অনুপ্রবেশ করতে পারে না।
ইসলামি শরিয়ত একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা, যা মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং তা আল্লাহ ও তদীয় রাসুলের বাণীর ওপর প্রতিষ্ঠিত। যে ব্যক্তি এটাকে আঁকড়ে ধরবে সে নাজাত পাবে, আর যে তা থেকে দূরে থাকবে সে ধ্বংস হবে। পূর্ববতী জাতি তো আল্লাহর আয়াতগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণেই ধ্বংস হয়েছিল। বস্তুত হেদায়েত ও মুক্তিপ্রাপ্তদের পথ সুস্পষ্ট এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ভ্রষ্টদের পথগুলোও পরিষ্কার। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর এ পথই আমার সরল পথ, কাজেই তোমরা এর অনুসরণ করো এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদের তার পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হও।’ সুরা আল আনআম : ১৫৩
২ জুন মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা, অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান
ভয়েস/আআ